২০২৩ সালের অক্টোবরে থেকে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৯৮ জন ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর বন্দী হিসেবে থাকা অবস্থায় নিহত হয়েছেন। গাজা থেকে অনেক শতাধিক মানুষ আটক হওয়ার পর তাদের মধ্যে নিখোঁজের সংখ্যাও বাড়ছে, যা করে আরও বেশি মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা করছে মানবাধিকার সংগঠন ফিজিশিয়ান্স ফর হিউম্যান রাইটস–ইসরায়েল (পিএইচআরআই)। ডিয়ার গার্ডিয়ানসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
পিএইচআরআই-এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব মৃত্যু ঘটেছে শারীরিক নির্যাতন, চিকিৎসা না দেয়া এবং অপুষ্টির কারণে। তারা এই তথ্য সংগ্রহের জন্য তথ্য অধিকার আইনের অধীন বিভিন্ন নথি, ফরেনসিক রিপোর্ট, আইনজীবী, স্বজন এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করেছে।
প্রথম আট মাসের পরিস্থিতি নিয়ে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের পূর্ণাঙ্গ তথ্য থাকলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেড়ে গেছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এই সময়টিতে গড়ে প্রতি চার দিনে একটি করে বন্দী মৃত্যুবরণ করেছেন। মে ২০২৪ পর্যন্ত ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এই হেফাজত মৃত্যুর তথ্য আপডেট করেছে, তবে পিএইচআরআই’র গবেষকেরা আরও ৩৫টি অজানা মৃত্যুর ঘটনাও নিশ্চিত করেছেন।
নাজি আব্বাস, পিএইচআরআই-র বন্দী ও আটক বিষয়ক বিভাগের পরিচালক, বলেছেন, এ সংখ্যাগুলো খুবই বড়। তবে তিনি অবহিত করে বলেছেন, এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে, কারণ অনেকের মরদেহ ও মৃত্যুর খবর তাদের কাছে পৌঁছায়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত—হেফাজতে থাকা অনেক মানুষই মৃত্যুবরণ করেছেন, যাদের বিষয়ে আমাদের কোনও তথ্য নেই।’
ইসরায়েলের গোপন নথিতে দেখা গেছে, গাজা থেকে আটক হওয়া কয়েকজন ফিলিস্তিনিকে কারাগারে মারা গেছেন। তবে এই রিপোর্ট বলছে, অধিকাংশ নিহত ব্যক্তি সাধারণ বেসামরিক মানুষ, যারা হামাস বা ইসলামিক জিহাদের যোদ্ধা নয়। দ্য গার্ডিয়ান, ‘+৯৭২ ম্যাগাজিন’ এবং হিব্রু ভাষার স্থানীয় গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে।
২০২৪ সালের মে মাসে সেনাবাহিনীর একটি ডেটাবেসে দেখা গেছে, যেখানে হামাস ও ইসলামিক জিহাদের ৪৭ হাজারের বেশি যোদ্ধার নাম রয়েছে, সেখানে শ্বাসরুদ্ধ হেফাজতের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল মাত্র ২১ জন। কিন্তু একই সময়ে গাজা থেকে আটক হওয়া অস্বচ্ছ ব্যাবস্থায় মারা গেছেন ৬৫ জন ফিলিস্তিনি।
এই সব মৃত্যুর তালিকা অসংখ্য ব্যক্তি, যারা কোনও অভিযোগ বা বিচার পায়নি। এর মধ্যে কয়েকজন ছিলেন ইসরায়েলের নাগরিকত্ব বা অধিকারপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি।
দুই বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে ইসরায়েলি কারাগারে ফিলিস্তিনিদের ওপর শারীরিক ও যৌন সহিংসতার মতো নিষ্ঠুরতার ঘটনা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। এমনকি, ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন–গভির কারাগারে বন্দীদের জন্য গোপন কক্ষে এমন একটি পরিবেশের কথা প্রকাশ্যে বলেও গর্ব করেছেন, যেখানে বন্দীরা দিন আলো দেখেন না।
বিরোধী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা এর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ তুলেছেন। তারা বলছেন, আইনের নিয়মভঙ্গের অভিযোগ তুললেও কোনও উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অস্ত্র ও বন্দুকের মাধ্যমে নির্যাতন চালানো, মৃত্যু বেড়ে যাওয়া—এসব হচ্ছে সাধারণ ঘটনা।
নাজি আব্বাস মন্তব্য করেছেন, ‘এটা একেকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং পুরো ব্যবস্থায় এটা বিস্তার লাভ করেছে। এটি চলতেই থাকবে।’ এর মূল কারণ, ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের মধ্যে দায়মুক্তির সংস্কৃতি। দু’বছর সময়ে একটিমাত্র ঘটনায় বিচার হয়েছে, তার জন্য অভিযুক্ত সেনাকে মাত্র সাত মাসের সাজা দেওয়া হয়েছে। আর এক ঘটনায় বিচার শুরু হলে ডানপন্থীরা বিক্ষোভ করে, সামরিক বিভাগের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার হয়। এখন তারা এই মামলা প্রত্যাহার করতে চাইছে।
তিনি আরও বলেন, ‘অসংখ্য মৃত্যুর পরেও কোনো কর্তৃপক্ষ কেউই এখনো গ্রেপ্তার বা মামলা করেনি। এই নীতিগুলো এখনও চালু থাকলে, সব ফিলিস্তিনি বন্দীর জন্য ঝুঁকি থাকবে—সুস্থ থাকলেও, কমবয়সী হলেও বা দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা থাকার পরও।’
অবশ্য কিছু মৃত্যু বেশ আলোচিত হয়েছে, যেমন, ৫০ বছর বয়সী আদনান আল–বুরশ। তিনি আল–শিফা হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগের প্রধান ছিলেন। চার মাস আটক থাকার পর ওফের কারাগারে তিনি মারা যান। তাঁর সঙ্গে থাকা একজন জানান, মৃত্যুর আগে বুরশকে প্রহরীরা আঙিনায় নিয়ে আসে—তিনি ছিলেন আহত ও কোমর থেকে নিচে উলঙ্গ। এখনও পর্যন্ত মরদেহ গাজায় ফেরত দেয়া হয়নি।
অন্যদিকে, অনেকের মৃত্যু রয়েছে অজানার মতো। অনেক মৃতদেহের পরিচিতি বা নাম জানা সম্ভব হয়নি। কারাগার ও সামরিক বাহিনী শুধু মৃতের সংখ্যা ও কোথায় মারা গেছে, তার তথ্য দিয়েছে, তবে তাদের নাম বা বিস্তারিত তথ্য দেননি। এর মধ্যে বেশিরভাগই গাজার নাগরিক।
বন্দীদের পরিবারগুলোও হয়তো এখনো জানে না যে তাদের প্রিয়জন মারা গেছেন। কারণ, ইসরায়েল বন্দীদের অবস্থান জানানো বা তথ্য দেয়ার ব্যাপারে ইচ্ছাকৃতভাবে কঠোরভাবেই বাধা দিয়ে থাকে। যুদ্ধের প্রথম সাত মাসে গাজা থেকে আটক হাজারো মানুষের পরিবারের তথ্যই রveal হয়নি। পিএইচআরআই বলছে, এর মধ্যে মূল নীতি ছিল বলপূর্বক গুমের মতো।
২০২৪ সালের মে মাসে গাজার ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে জানার জন্য একটি ইমেইল ঠিকানা চালু হলেও পরিস্থিতির উন্নতি খুবই ধীর। পিএইচআরআই মন্তব্য করে বলছে, ‘অব্যাহত ব্যর্থতা ও অস্বচ্ছতা এখনো রয়ে গেছে।’
আইনজীবীরা বারবার বলছেন, তাদের আবেদন করলে দেখা যায়, যে ক্লায়েন্টের ব্যাপারে তথ্য চাইছে, তাদের এইজড়ো বা গ্রেপ্তারের রেকর্ড বা নথিপত্রই নেই, যদিও সেই গ্রেপ্তার সম্পূর্ণ প্রমাণিত। মানবাধিকার সংগঠন হামোকেদ জানিয়েছে, গত ছয় মাসে প্রায় ৪০০ ব্যক্তির ব্যাপারে ‘নথি নেই’ হিসেবে বলা হয়েছে।
সম্ভবা সবচেয়ে আলোচিত একজন বন্দী হলেন হুস্সাম আবু সাফিয়া, গাজার কামাল আদওয়ান হাসপাতালে পরিচালকের। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাঁকে এক অভিযানে আটক করা হয়। ভিডিওতে দেখা গেছে, ইসরায়েলি সৈন্যরা তাঁকে অ্যারেস্ট করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এরপর এক সপ্তাহের বেশি সময় পর্যন্ত সেনাবাহিনী দাবি করে, তাঁরা তাঁকে হেফাজতে নেননি।
Leave a Reply